মুহাম্মদ আতিকুর রহমান হান্নান,বাঁশখালী: বাঁশখালীর বুক ছিড়ে যে খালটি প্রবাহিত সেটা হলো জলকদর খাল। এই খালটি সুদূর কাল থেকে সাগর পথে বাঁশখালীর যাতায়াত ও ব্যবসায়ীদের মালামাল আনা-নেওয়ার অন্যতম যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভূমিকা রেখে আসছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে খালটি দুই পাশের অবৈধ দখলদারদের দখল এবং সংস্কার না করায় সরু হয়ে পড়েছে। দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে লবণ ব্যবসায়ীরা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ লবণ সরবরাহ করতে গিয়ে ইঞ্জিলচালিত বোটগুলো চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের ৮টি পাহাড়ি ছড়ার ঢল ও বন্যার পানি নিষ্কাশন হতে না পারায় সর্বত্র বন্যার সৃষ্টি হয়। সাধারণ জনগণের মালামালের ক্ষতিসাধন হয়।
একসময় বাঁশখালীর ব্যবসায়ীগণ নৌকা ও সাম্পানের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে জলকদর খাল হয়ে মালামাল নিয়ে আসতেন শঙ্খ নদী হয়ে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত থাকলেও জলকদর খালের অধিকাংশ এলাকা অবৈধ দখলদার ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পূর্বের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ।
অপরদিকে জলকদর খালের সাথে বাঁশখালীর পূর্বাঞ্চলের ৮টি পাহাড়ি ছড়ার প্রবাহিত পানি খালে নামার জন্য অবস্থিত অধিকাংশ স্লুইচ গেট নানাভাবে দখল ও বন্ধ থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যার সৃষ্টি হয় খালের পূর্বাঞ্চলের এলাকাগুলোতে।
জলকদর খালটি শঙ্খ নদী হয়ে খানখানাবাদের অভ্যন্তরে বাহারছড়া, কাথারিয়া, সরল, গন্ডামারা, শীলকূপ, ছনুয়া, শেখেরখীল মধ্যবর্তী হয়ে আবারো দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের সাথে পড়েছে। এই জলকদর খালটি জনগুরুত্বপূর্ণ হলেও নানাভাবে দখলে থাকায় বর্তমানে পানি নিস্কাশনে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে সাধারণ জনগণ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
খালটি সংস্কারের জন্য সকলের পক্ষ থেকে দাবি জানানোর প্রেক্ষিত চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার জলকদর খাল দখল ও ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সোমবার (৫ ডিসেম্বর ২০২২) সকালে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং বিচারপতি মোহাম্মদ আলির ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এর আগে জলকদর খাল ভরাট করে ভবন নির্মাণের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিচ ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) জনস্বার্থে রিট পিটিশন দায়ের করলে শুনানি শেষে আদালত ৪ সপ্তাহের রুল জারি করে।এইচআরপিবির পক্ষে আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন অ্যাডভোকেট মো. ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট রিপন বাড়ৈ। পিটিশনে পরিবেশ সচিব, পানি উন্নয়ন সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসক ও চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারসহ ১২জনকে বিবাদী করা হয়।এইচআরপিবির পক্ষে আদালতে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। তাকে সহায়তা করে অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভুইয়া ও অ্যাডভোকেট সঞ্জয় মন্ডল। সরকার পক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল আবুল বাশর সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, শুনানি শেষে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ৪ সপ্তাহের রুল জারি করে। জলকদর খাল ও জায়গা দখল করে ভরাট ও ভবন নির্মাণ বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না এবং খালের অভ্যন্তরে থাকা সব অবৈধ দখল ও স্থাপনা উচ্ছেদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা বিবাদীদের জানাতে বলেছেন আদালত।আদালত এক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে জলকদর খালে আর যাতে দখল ও স্থাপনা নির্মাণ না করা হয়, তা নিশ্চিত করতে বিবাদীদের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, বাঁশখালীর ইউএনওসহ ৬ জনকে দুই সপ্তাহের মধ্যে কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট দাখিল করার নির্দেশ দেন। আদালত জেলা প্রশাসক, নির্বাহী প্রকৌশলী চট্টগ্রাম ও বাঁশখালীর ইউএনওকে জলকদর খালের সিএস, আরএস অনুসারে জরিপ করে দখলদারদের তালিকাসহ ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে অ্যাভিডেভিট করে রিপোর্ট দাখিলের নির্দেশ দেন।শুনানিতে এইচআরপিবি পক্ষের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ আদালতকে বলেন, খাল দখল করে ভবন নির্মাণ চললেও প্রশাসন চুপ করে আছে। যদিও আইন ও বিধি অনুসারে খাল ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা আছে।তিনি বলেন, এ রকম খাল দখল করে অনেক ক্ষেত্রে পানির প্রবাহ করা হয়, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করবে। মহামান্য হাইকোর্ট জলকদর খাল উদ্ধারের জন্য প্রাথমিকভাবে সীমানা নির্ধারণের নির্দেশ দেন।হাইকোর্টের নির্দেশনা মতে বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর২০২৩) সকালে বাঁশখালীর জলকদর খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে বাঁশখালী উপজেলা প্রশাসন। উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে সীমানা নির্ধারণ ও উদ্ধার কার্যক্রম খানখানাবাদ ঈশ্বর বাবুর হাট অংশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবেই শুরু করেছে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আবদুল খালেক পাটোয়ারী, বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. কামাল উদ্দিনসহ বাঁশখালীর বিভিন্ন দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আবদুল খালেক পাটোয়ারী বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে আমরা জলকদরের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু করেছি। সীমানা নির্ধারণের জন্য জেলা প্রশাসক ৬ জন সার্ভেয়ার নিয়োগ দিয়েছেন। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে কথা বলেছি। তারা একজন সার্ভেয়ার দিবে। আমরা সীমানা নির্ধারণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বুঝিয়ে দিবো।’
এ বিষয়ে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমিন আক্তার বলেন, ‘জলকদরের মূল সীমানা নির্ধারণের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কেউ যেন স্থাপনা নির্মাণ না করে তা অবগত করা হয়েছে। জলকদর খাল উদ্ধারের প্রাথমিক কাজ হিসেবে জলকদরের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রম শুরু করেছি।এদিকে উদ্ধারের জন্য প্রাথমিক কাজ শুরু হলেও দখল বানিজ্য মোটেই কমছে না,যা নিয়ে সর্ব সাধারণের কাছে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তাই সর্ব সাধারণের জোর দাবি যথাযথ কতৃপক্ষ অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দখল মুক্ত করুক জলকদর খাল।এবং জলকদর খাল ফিরে পাক তার পূর্ণ যৌবন।
শিরোনামঃ
নোটিশঃ
ঐতিহ্যবাহী বাঁশখালীর জলকদর খাল দখল ও ভরাট বানিজ্যের যাঁতাকলে
- Reporter Name
- Update Time : ০৯:৪৮:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ৯ অক্টোবর ২০২৩
- ১৭৯ Time View
Tag :
Popular Post